জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায়। মাছের ঘেরে ঘেরে ঘেরাও হয়ে পড়েছে বিল, মাঠ ও মানুষের জীবন। সৃষ্টি হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। ৩০ বছর আগে ঘের আসার পর মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে- জরাজীর্ণ খড়ের বসতঘরের জায়গায় টিন-কাঠ, আধাপাকা কিংবা পাঁকা ঘর উঠেছে। বিগত কয়েক বছর তাপমাত্রার ভারসাম্যহীন তারতম্য ও দুর্যোগের কারণে মাছের ঘেরে ও কৃষিতে ব্যাপক ÿতি হচ্ছে। ÿতি কাটিয়ে উঠতে গিয়ে কমপÿে ৮০ ভাগ মৎস্য ও কৃষিজীবি এখন দেনাগ্রস্থ। একাধিক গ্রামের মানুষের সাথে আলাপচারিতায় এই তথ্য পাওয়া গেছে।
ঘেরের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব সম্পর্কে চিতলমারী উপজেলা জেষ্ঠ্য মৎস্য কর্মকর্তা সোহেল মো. জিলস্নুর রহমান রিগান কালের কন্ঠকে বলেন, প্রচন্ড রোদ ও অসময়ে অতিবৃষ্টির তাপমাত্রার ভারসাম্যহীন তারতম্যের কারণে এ বছর মাছের ঘেরে ব্যাপক ÿতি হয়েছে। সাধারণত ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা ঘেরের চিংড়ি ও সাদা মাছের জন্য উপযোগী। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ঘেরে অ্যামোনিয়া (ঘঐ৩) বিষাক্ততা তীব্র আকার ধারণ করে। পানি কম থাকলে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। ফলে ‘হিট স্ে্রাকে’ মাছ মারা যায়। তাছাড়া করোনার বিধিনিষেধের কারণে যাতায়াত ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। ফলে ঘেরে বেশিদিন মাছ রাখতে মৎস্যজীবিদের ব্যয় বেড়েছে। তিনি বলেন, এ বছর একদিকে তাপমাত্রা বেশি ছিল; অপরদিকে দেরিতে বৃষ্টি হয়েছে। ঘেরে মাছ ছাড়তে হলে তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট পানি থাকতে হয়। এ বছর ঠিক সময়ে (এপ্রিল-মে) রেনুপোনাসহ অন্যান্য পোনা ছাড়তে পারেনি মৎস্যজীবিরা। কারণ, এবছর নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে কমপÿে এক মাস দেরিতে বৃষ্টি হয়েছে। আবার এই এক মাস দেরির ফল পড়ে মাছ উৎপাদন থেকে বিপনন পর্যায়ে। মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিতে ঘেরগুলো পস্নাবিত হয়েছে। আবহাওয়ার এই তারতম্য জলবায়ু পরিবর্তনেরই অংশ। এর প্রত্যেকটি ÿেত্রে মৎস্যজীবির ব্যয় বাড়ে। তা যোগাড় করতে দেনাগ্রস্থ হয় অধিকাংশ মৎস্যজীবি। মাছ ও কৃষিপণ্য একই ঘেরে উৎপাদন হওয়ার কারণে আপাত দৃষ্টিতে দেনা বোঝা যায়না। আগের দেনা পরিশোধ করে নতুন দেনা হয়। এভাবে চলে এখানের মানুষের জীবন।
সোহেল মো. জিলস্নুর রহমান রিগান আরো বলেন, এলাকার ঘের মালিকেরা মাছের খাবারের জন্য প্রচুর পরিমাণে শামুক দেয়। পরিবেশের ছাকার খ্যাত শামুক নিধন আইনে অন্যায়। জীবন্ত্ম শামুক মাটির ময়লা আবর্জনা খেয়ে পরিস্কার করে শুদ্ধতা আনে। মাটি ও পানির উপকার করে।
চিতলমারী উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় মোট চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা ১৭ হাজার ৭৩০টি। যার মোট আয়তন ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। এরমধ্যে ১৪ হাজার ৭৫৮টি ঘেরে গলদা ও দুই হাজার ৮৭২টি ঘেরে বাগদা চিংড়ি ও ছয় হাজার ৯০০টি পুকুরে বিভিন্ন মাছের চাষ হয়। এখানের চাষিরা বছরে গড়ে ৫৮১ মেট্রিকটন বাগদা ও দুই হাজার ৬৫০ মেট্রিকটন গলদা চিংড়ি এবং বিপুল পরিমাণ সাদা মাছ উৎপাদন করেন। মৎস্য চাষী আছে সাত হাজার ৫০০ জন। মৎস্যজীবি রয়েছেন দুই হাজার ৭০২ জন।
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বারাশিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জলাবদ্ধ নোংরা পরিবেশে রয়েছে অধিংকাশ বসতবাড়ি, রান্নাঘর, গোয়ালঘর, গ্রাম বা বাড়ি ঢোকার রাস্ত্মা। কোন কোন বাড়িতে যাতায়াত করতে হয় নৌকায় কিংবা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে। বাড়ির চারপাশ ডুবে থাকায় গরম্নর খাবারের জন্য ভাসমান জায়গা করা হয়েছে। চারপাশে মাছের ঘেরের জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাধের অভ্যন্ত্মরের গ্রামগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক নিচু বলে স্থানীয়রা জানান।
বারাশিয়া পশ্চিমপাড়ার আলেক শেখের ছেলে মো. লিয়াকত শেখ (৬৫), আকবর আলীর ছেলে মিলন শেখ, প্রতিবেশি ইস্রাফিল, কালাম শেখ সহ অনেকে জানান, বর্ষাকাল হতেই দুর্ভোগ শুরম্ন হয়। সাপ, ব্যাঙ, কেঁচোসহ নানা পোকামাকড়ের সাথে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয়। শ্রাবণ থেকে কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত্ম গ্রামবাসী জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকে। বৃষ্টি হলেই উঠোন ডুবে যায়। রান্নাঘরের চুলা ভিজে ওঠে। কড়া রোদ না হলে উঠোন, চুলা, বাড়িঘর শুকোয় না। এই অবস্থায় বিপদ আপদের ভয়ে পরিবার ফেলে কাজে দুরে যেতে পারেনা। বিলের শাপলা তুলে, শামুক কুড়িয়ে কিংবা পাখি ধরে অনেকের সংসার চলে। শিশু-কিশোরেরাও কাজে জড়িয়ে পড়ে। বাড়িগুলোর পাশের জমিতে মাছের ঘের। এলাকার খালগুলো হতেও পানি সরতে চায়না। কারণ গ্রামের অভ্যন্ত্মরের তুলনায় প্রায় পাঁচ-সাত কিলোমিটার দুরের ওয়াপদা (পাউবো) বাঁধের সস্নুইচগেটের পাশের খালগুলোর তলদেশ উঁচু। তাদের পাড়ার শতাধিক পরিবার কমপÿে চার মাস জলাবদ্ধ থাকে বলে তারা জানান। আশেপাশের গ্রামের অসংখ্য পরিবার তাদের মতো জলাবদ্ধ পরিবেশে বসবাস করছে। তারা বৃষ্টির পানি পান করেন। ওই চার মাস লেট্রিনেও কষ্ট হয়।
বারাশিয়া বড়জিলা এলাকার বাসিন্দা জাকারিয়া শেখের ছেলে এমদাদুল শেখ জানান, ঘেরগুলোর সাথে খালের সরাসরি সংযোগ না থাকলেও খালের পানি প্রবাহ ঠিক থাকলে ঘেরের জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ ধারণ করতে পারেনা। মাটি হতে চুইয়ে চুইয়ে পানি কমে যায়। তাই খালগুলো ঠিক করতে হবে। গ্রামের অভ্যন্ত্মরের খালগুলোর তলদেশের তুলনায় বাধের পাশের খালের তলদেশ অনেক গভীর করতে হবে। গজালিয়া খাল, ডাক্তারের খাল, বাঁশতলী, শকুনিয়া, বাড়বাড়ির খালসহ এলাকার খালগুলো পরিকল্পিতভাবে কাটা হলে এই স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসন হতে পারে।
সদর ই্উপি চেয়ারম্যান মো. নিজাম উদ্দিন শেখ জলাবদ্ধতা সম্পর্কে জানান, বারাশিয়া, কলিগাতী, শ্রীরামপুর, ডুমুরিয়া, খড়িয়া, আড়ুলিয়াসহ অন্ত্মতঃ ১৫টি গ্রামের অনেক পরিবার বছরের কমপÿে চার মাস জলাবদ্ধ থাকে। অসংখ্য বসতবাড়ি, রান্নাঘর, গোয়ালঘর ডুবে থাকে। মিষ্টি জলের ঘেরগুলোর সাথে নদী, খালের সরাসরি সংযোগ না থাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। #