রাজশাহী-ঢাকা রুটের আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিটহীন যাত্রীদের নিকট থেকে জরিমানার টাকা আদায়ের পর সিংহভাগই হচ্ছে লুট। সরেজমিন গত ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেন ঘুরে এ অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। ওই ট্রেনে চেপে আসা রাজশাহীগামী টিকিটহী যাত্রীদের নিকট থেকে টাকা আদায় করা হলেও তাঁদের অধিকাংশকেই কোনো রশিদ দিতে দেখা যায়নি। এমনকি দুই-তিনজন বা তার অধিক যাত্রীর নিকট থেকে টিকিটের সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি টাকা আদায় করা হলেও রশিদ দেওয়া হচ্ছে হাঁফ টিকিটের। এমন চিত্রও উঠে এসেছে সরেজমিন ওই ট্রেন ঘুরে।
অভিযোগ উঠেছে, শুধু পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনই নয়, এভাবে ঢাকা-রাজশাহীর সবকটি ট্রেনে একই কায়দায় টিকিটহীন যাত্রীদের নিকট থেকে জরিমানার টাকা আদায় করে অধিকাংশই পকেটে পুরছেন ট্রেনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমনকি পশ্চিমাঞ্চলের ৫৪টি আন্তঃনগর ট্রেনেই এই অবস্থা বিরাজ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
২৯ ডিসেম্বর রাত ১১ টায় ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে ছাড়ার কথা ছিল রাজশাহীগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটির। তবে প্রায় ১৫ মিনিট দেরিতে ছাড়ে ট্রেনটি। বরাবরের মতোই বিমানবন্দর স্টেশন যাওয়ার আগেই ট্রেনটির ১০টি বগির সবগুলোই প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ। বিমানবন্দর আসার পরে সিট পরিপূর্ণ হয়েও নন এসির বগিগুলোতে যেন ধাপ ফেরার যায়গা নাই। বিশেষ করে ট্রেনের বগিগুলোর মাঝখানে অবস্থিত টয়লেটের সামনে দরজার মুখ বরাবর গায়ে গা ঘিঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের। যাদের অধিকাংশই হলেন টিকিটবিহীন যাত্রী। আবার দুই-একজন স্ট্যান্ডিং (দাঁড়িয়ে থেকে যাওয়া) টিকিট সংগ্রহকারী যাত্রীও ছিলেন। এমন অবস্থায় রাত ১২টার দিকে অনেকটা ঠেলা ঠেলি করে ৫-৬ জন টিটিই ট্রেন টিকিট পর্যবেক্ষক), এ্যাটেনডেন্ট এবং গার্ড সদস্যরা দল বেধে যাত্রীদের নিকট থেকে টিকিট দেখতে শুরু করেন।
ওই ট্রেনের ঝ বগিতে ১২-১৫ নম্বর সিটে বসেছিলেন দুইজন নারী, তাদের দুটি শিশু সন্তান (যাঁদের বয়স ৪-৬ মধ্যে), একজন বৃদ্ধ ও একজন ৪০-৪৫ বছরের ব্যক্তি। এসময় টিকিট সংগ্রহকারীরা এসে তাঁদের নিকট থেকে টিকিট চাইলে একজন নারী চারটি টিকিট বের করে দেন। টিকিট দেখেই টিটিই কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আরও দুটি টিকিট দেন।’ ওই নারী তখন বলেন, ‘চারজনের তো টিকিট দিলাম।’ প্রতিউত্তরে টিটিই বলেন, ‘বসে আছেন ৬ জন। তাই টিকিট দিবেন ছয়টি।’ এবার নারী বলেন, ‘দুজন শিশু মিলে ছয়জন।
আমরা চার সিটেই বসে আছি। তাহলে ৬জনের টিকিট দিব কেন? তখন টিটিই বলেন, ‘তাহলে বাকি দু’জন নেমে যান। ট্রেনে ২ বছরের বেশি বয়স্ক গেলে সবার টিকিটই লাগবে।’ এবার নারীর সোজা উত্তর,‘ স্যার আমার জানা নাই। মাফ করে দেন।’ টিটিই বললেন মাফ করার সুযোগ নাই। দুটো টিকিট কাটেন তাহলে আর সমস্যা হবে না। ওই নারী বললনে, ‘দেন তাহলে দুটি টিকিট।’ টিটিই বললেন, ‘ডাবল জরিমানাসহ ১৩৬০ টাকা দেন।’ তখন ওই নারী বললেন, জরিমানা দিব কেন, ‘যা দাম তাই নেন।’ একপর্যায়ে মাঝে আরও কিছু কথাকাটাকাটির পরে ওই নারীর নিটক থেকে দেন দরবার শেষে ৭০০ টাকাটা নিয়ে নিজের নোটবুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন টিটিই কামরুল ইসলাম।
এবার ওই নারী দুটি টিকিট চাইলে টিটিই কামরুল ইসলামের জবাব, ‘টিকিট লাগবে না আর। আমি দেখবোনি।’
ওই নারীর সঙ্গে টিকিট নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ ধরে এবার এই প্রতিবেদক অনুসরন করতে থাকেন ট্রেনের ভিতরে টিকিট পর্যবেক্ষক দলের ওই সদস্যদের। এর পর গোটা ট্রেনে ওঠা টিকিটবিহীন যাত্রীদের নিকট থেকে যেভাবে দাম-দর করে টিকিট বিক্রির নামে টাকা আদায় করা হলো-তা কেবল স্বচক্ষে দেখেই অনুধাবন করা যাবে। গোটা ট্রেনে প্রায় ১৩০ জন যাত্রী ছিলেন টিকিটবিহীন। কিন্তু জরিমানার রশিদ ধরিয়ে দেওয়া হলো হাতে-গোনা ২০-২৫ জনকে। বাকি সব যাত্রীদের টাকা পকেটে পুরলেন ওই পর্যবেক্ষক দলের দল নেতা।
পরে জানতে চাইলে নাসরিন পারভীন নামের ওই নারী বলেন, ‘টিকিটের নামে টাকা ঠিকই নিল। কিন্তু সেগুলো আর সরকারের ঘরে জমা দিবে বলে মনে হয় না। এরা লুটেপুটে খাবে।’
ওইদিন ট বগিতে থাকা আলি আসগর নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, তাদের নিতজনের নিকট থেকে টিকিট না থাকার কারণে দেড় হাজার টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু রশিদ দেওয়া হয় ৬৮০ টাকার। এর প্রতিবাদ করলে ট্রেনের টিটিই বয় দেখিয়ে বলেন, ‘এই রশিদ না নিলে জরিমানাসহ ডাবল টাকায় আদায় করবো।’ উপায়ন্তর না পেয়ে আলী আসগর সেই রশিদের ঢাকা থেরে রাজশাহীতে ফেরেন।’
‘ঞ’ বগিতে থাকা রাশেল নামের এক যাত্রী বলেন, ‘ট্রেন ছাড়ার মূহর্তে আমি ট্রেনে উঠি। আমার কাছে টিকিট ছিল না। কিন্তু ৩০০টাকা দিয়েছি। টিকিট চেককারীরা আর কিছু বলেনি। আর টিকিট চেক করতেও নাকি আসবে না। কষ্ট হচ্ছে বসার যায়গা নাই। টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে।’
টয়লেটের পাশে একটি টুলে বসেছিলেন মাইনুল ইসলাম নামের এক যুবক। পাশেই কোণায় আরেকটি টুলে বসেছিলেন তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন। মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘টিকিট নাই। রেলের এক বড় ভাইকে বলে এথানে বসার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে তার জন্য ট্রেনের গার্ডকে ৭০০ টাকা দিতে হয়েছে। তবে কোনো রশিদ দেয়নি।
রেলওয়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, এভাবে টিকিহীন যাত্রীদের নিকট থেকে জরিমানা আদায়ের নামে প্রতিদিন কেবল ঢাকা-রাজশাহী রুটের চারটি ট্রেন থেকেই অন্তত ২ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছেন রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর গোটা পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে চলাচলকারী ৫৪টি আন্তঃনগর ট্রেন থেকে প্রতি মাসে অন্তত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ট্রেনের ভিতরে টুলে যাত্রী বসিয়ে দিয়েও বাণিজ্য করেন টিকিট পর্যবেক্ষণের দায়িত্বরত সদস্যরা।
জানতে চাইলে বুধবার রাতে পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনের দায়িত্বরত টিটিই কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জরিমানা করলে তো দ্বিগুন হয়। কিন্তু অনেক যাত্রীই ঠিকমতো টিকিটের টাকায় দিতে পারে না। তাই কমবেশি করে পরবর্তিতে আমরা গড়ে রশিদ কেটে টাকা কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেয়। কোনো অনিয়ম হয় না।’
রেলওয়ে সূত্র মতে, টিকিটবিহীন যাত্রীদের নিকট হাতে হাতেই রশিদ দিয়ে দ্বিগুন টাকা আদায় করতে হবে। কিন্তু সেটি না করে আাদয়কৃত অর্থের বেশিরভাগই লুটপাট করছেন টিকিট পর্যবেক্ষকরা। এতে করে সরকার শুধু পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটেই মাসে অন্তত দেড় কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছেন। আর সেই টাকা লুটে নিচ্ছেন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এদিকে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘এই অঞ্চলের পাকশি ও লালমনিরহাট বিভাগ থেকে প্রতি মাসে টিকিটহীন যাত্রীদের নিকট থেকে টিকিট বিক্রিসহ জরিমানা আদায় হয় গড়ে প্রায় এক কোটি টাকা। ২৭ জোড়া (৫৪টি) আন্তঃনগর ট্রেন থেকে এই টাকা আয় হয়। কিন্তু যাত্রীদের নিকট থেকে এই দ্বিগুন টাকা উত্তোলন করা হয়। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই মাসে ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকিট বাতিলের পর জরিমানাসহ টিকিট বিক্রি করে আয় হয়েছে দুই কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অথচ আগের মাসগুলো সর্বোচ্চ এক কোটি ২০লাখ টাকা জমা হয়েছে রেলের কোষাগারে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পশ্চিশাঞ্চল রেলওয়ের প্রদান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা আহসান উল্লাহ ভুইয়া বলেন, ‘আমরা টিকিটহীন যাত্রীদের নিকট থেকে জরিমানাসহ অর্থ আদায় করে থাকি। এখানে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নাই।’