স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান ও মুজিব জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকায় প্রথম দিনের সফরে ঠাসা কর্মসূচিতে দিন পার করলেন। করোনাকালে দীর্ঘ লকডাউনের পর এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। সফরের প্রথম দিন মোদীকে বেশ উচ্ছসিত দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বরণ করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও কিছু স্থাপনা সেজেছে বর্ণিল সাজে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে পথে পথে বসানো হয়েছে তোরণ। সড়কের খুঁটি, ভবন ও দেয়ালে মোদীর ছবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। সড়কের সৌন্দর্যবর্ধক ভাস্কর্যগুলোতেও ফুলের সঙ্গে শোভা পাচ্ছে মোদির ছবি। বড় বড় করে বিভিন্ন জায়গায় লেখা হয়েছে, ‘স্বাগতম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী’।
সকাল সাড়ে ১০টার পর তাকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। উনিশবার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানানোর পর বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে বিমানবন্দরেই তাকে গার্ড অব অনার এবং লাল গালিচা সম্বর্ধনা দেয় সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে নরেন্দ্র মোদী হেলিকপ্টার যোগে সাভার স্মৃতিসৌধে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। সেখানে তিনি পুষ্পস্তবক অর্পণ, ভিজিটর বইয়ে স্বাক্ষর ও গাছের চারা রোপণ করেন। স্মৃতিসৌধ থেকে হেলিকপ্টারে ফিরে তিনি আসেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে।
সেখান থেকে ফিরে তিনি হোটেলে আসেন। হোটেলে অবস্থানকালে দু’ঘন্টায় তিনি বাংলাদেশের বিশিষ্টজন, ক্রীড়াঙ্গনের সদস্য ও তারকাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। পরে ১৪ দল এবং সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক সেরে মুজিবকোট পরিধান করে তিনি যোগ দেন জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠান শেষে তিনি যোগ দেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানে রাতে বাপু-বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল জাদুঘরের প্রদশর্নী হয়। দুই দেশের জাতির জনককে এক ফ্রেমে বন্দি করা হয়। তাদের কৃতকর্ম ওই জাদুঘরে দেখানো হয়।
বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পাশাপাশি উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার সব ইস্যুতে সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। এছাড়াও ভারত প্রতিশ্রুত তিন কোটি করোনার ভ্যাকসিন নিশ্চিতভাবে পাবে বাংলাদেশ সে কথাও জানিয়েছেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত রাষ্ট্র পর্যায়ের নেতৃত্ব সোনালি অধ্যায়ে পৌঁছাতে চায় বলেও আশ্বাস দিয়েছেন মোদী।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর, এলডিসি থেকে উত্তোলনসহ বঙ্গবন্ধুকে গান্ধী পুরস্কার নিয়ে কথা হয়েছে। কানেক্টিভিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বরাত দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মোদীজী কোভিডের সময়ও আমি বাংলাদেশে এসে খুব খুশি। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জয় মানে আমাদেরও জয়। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের সঙ্গে আসতে পেরে আমরাও আনন্দিত। ভারতের সমর্থন সব সময় থাকবে।
বাংলাদেশ সফর নিয়ে মোদীর দুই টুইট: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে শুক্রবার ঢাকায় এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তিতে মোদীর এ সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
এরইমধ্যে বাংলাদেশ সফর নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে দুটো টুইট করেছেন তিনি। বাংলাদেশ সফরের কথা উল্লেখ করে বাংলায় টুইটে মোদী লিখেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী সুলভ ও অংশীদারিত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান। আমরা এটিকে আরো গভীরতর করতে ও সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন যাত্রা সমর্থন করি।
ঢাকায় যাত্রা শুরুর আগে তিনি লেখেন, আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও আদর্শ স্মরণ করার প্রত্যাশায় রয়েছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উদযাপনের পাশাপাশি আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাই। তিনি লিখেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন গত শতাব্দীর অন্যতম দীর্ঘ নেতা, যার জীবন ও আদর্শ লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তার স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আমি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি দেখার অপেক্ষায় আছি। আমি পৌরাণিক ঐতিহ্যের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে দেবী কালিকে প্রার্থনা করার অপেক্ষায় রয়েছি। বিশেষত ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমার আলাপচারিতার প্রত্যাশায় আছি, যেখান থেকে শ্রীশ্রী হরিচন্দ্র ঠাকুর তার শুদ্ধ বাণী প্রচার করেছিলেন।
মোদীর সঙ্গে দেখা করতে পেরে উচ্ছ্বসিত জয়া-ফারিয়া, সম্মানিত সাকিবঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনের দুই তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান। আরো ছিলেন নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সালমা খাতুন ও তারকা ক্রিকেটার জাহানারা আলম। মোদির সঙ্গে দেখা করতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন মাশরাফি ও সাকিব। তারকা ক্রিকেটাররা ছাড়াও মোদির সঙ্গে দেখা করেছেন শোবিজের কয়েকজন তারকা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় দুই অভিনেত্রী জয়া আহসান ও নুসরাত ফারিয়া। আরো ছিলেন চিত্র পরিচালক রেদোয়ান রনি, সংগীত তারকা শারমিন সুলতানা সুমি প্রমুখ। নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে মোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ছবিও পোস্ট করেছেন নুসরাত ফারিয়া।
এদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে নিজেকে সম্মানিত বোধ করেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। সাক্ষাৎ শেষে সাকিব ভারতীয় সংবাদসংস্থা এএনআইকে বলেন, আমি মনে করি এই সফর দু’দেশের জন্য ফলপ্রসূ হবে। ভারতকে অসাধারণভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। আমি আশা করি ভবিষ্যতেও তিনি ভারতকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাবেন এবং আমাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক বহুমাত্রিক এবং তা দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। সম্পর্কের এই যাত্রা অনেক দীর্ঘ হবে বলে আমি আশাবাদী।
মোদির কাছে তিস্তাসহ ৫৪ নদীর পানির হিস্যা চেয়েছে জাতীয় পার্টি: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি বন্টন সদস্যার দ্রুত সমাধান এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে দেশের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। শুক্রবার রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-এ অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই আহ্বান জানানো হয়।
এ সময় তিস্তা সমস্যার পাশাপাশি অন-এরাইভাল ভিসা প্রদান ও স্কলারশিপ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয় তাদের মধ্যে। আলোচনাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক আয়োজনে উপস্থিত হতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব অক্ষয় হয়ে থাকবে। ভারত সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। বৈঠক সূত্র জানায়, আলোচনাকালে বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরো জোড়ালো হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাপা নেতৃবৃন্দ। এসময় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সম্পর্ক উন্নয়ন ও দু’দেশের কানেকটিভিটি বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, ২০১৯ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন পানি, বায়ু এবং পাখির কোনো সীমানা নেই। আমরা ওনার ওই বক্তব্যকেই স্মরণ করে দিয়েছি। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কী বললেন জানতে চাইলে জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেন, তিনি বলেছেন এ বিষয়ে তারা কাজ করছেন। এ ছাড়া কানেকটিভিটি, অন অ্যারাইভাল ভিসা এবং শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ নিয়ে তারা কথা বলেছেন।
এছাড়াও ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ১৪ দলের নেতারা। এই দুই বৈঠকের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।