ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরে দমন–পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা,গুম–খুন এবং বিএনপি–জামায়াতের নেতাকর্মীদের দমনসহ তিনটি জাতীয় নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার অভিযোগ থাকা শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এখনও বহাল তবিয়তে উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অনেকেই রাতারাতি নিজেদের পরিচয় বদলে নতুন বাস্তবতায় আনুগত্য দেখিয়ে তদবিরের মাধ্যমে এসপি,ডিআইজি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত আইজিপির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ আঁকড়ে ধরেছেন। এতে যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং প্রশাসনের ভেতরে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদার অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন ও লজিস্টিকস) মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন। তার বিরুদ্ধে বরিশালের সাবেক এসপি ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় অভিযুক্ত ডিআইজি এহসানুল্লাহকে পালাতে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে। গত ২৯ অক্টোবর ডিআইজি এহসানুল্লাহকে আটক করতে পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালানো হলে তিনি মোটরসাইকেলে করে রহস্যজনকভাবে পালিয়ে যান।
একাডেমির একাধিক সূত্রের দাবি,গ্রেপ্তার–প্রচেষ্টার খবর আগেভাগেই এহসানুল্লাহর কাছে পৌঁছে যায় এবং সেই তথ্য সরবরাহ করেন তবারক উল্লাহ নিজেই। যদিও ঘটনার পর একাডেমির পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বিষয়টিকে “রহস্যজনক পলায়ন” বলে উল্লেখ করেন, তবে অভ্যন্তরীণ মহলে একে স্পষ্টভাবে “ভিতরের সহযোগিতা” হিসেবেই দেখা হচ্ছে।তবারক উল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘদিন ধরে নারী পুলিশ সদস্যদের প্রতি অশোভন আচরণ, অনৈতিক প্রস্তাব ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগ ঘুরে বেড়ালেও চাকরির নিরাপত্তা ও ভয়ভীতির কারণে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাননি। একই সঙ্গে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি ও কাঙ্ক্ষিত পোস্টিং বা প্রশিক্ষণে মনোনয়নের বিনিময়ে অর্থ লেনদেনের অভিযোগও তার দায়িত্বকালজুড়েই আলোচিত। পুলিশ একাডেমির সরবরাহ, রক্ষণাবেক্ষণ ও লজিস্টিকস–সংক্রান্ত টেন্ডারে আত্মীয়প্রীতি ও নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের সুবিধা দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
তবারক উল্লাহ প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের ফ্যমেলি প্ল্যানিং প্রজেক্টে চাকুরি করেন। পরবর্তিতে এডহক বেসিসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করেন। এর পরে জেনারেল বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে ২০০১ সালে সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছরের ট্রেনিং শেষ পুলিশ ক্যাডারে এএসপি হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন তবারক উল্লাহ। তার বিপি নম্বর ৬৯০১১৪১০৮৭।
এরপরে জাতীয় নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের পরে তবারক উল্লাহসহ ২১জন এএসপিকে চাকুরি থেকে রিমুভ করা হয়। ২০০২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০০৮ সাল এর মার্চ মাস পর্যন্ত তবারক উল্লাহসহ এই ২১জন চাকুরিতে ছিলন না। আদলতে চাকুরি ফেরত পেতে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয় তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলার মাধ্যমে তা মিথ্য প্রমানিত হয়ে চাকুরি ফেরত পায়। এর পর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব ও তদবিরের কারণে তিনি একের পর এক সুবিধাজনক পোস্টিং পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কুড়িগ্রাম, সিলেট গোয়েন্দা বিভাগ,সিআইডি ঢাকা, টিএন্ডআইএমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তার পদায়ন নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৭ সালে ১২ই ডিসেম্বর ৯৯৯ সেবার সূচনালগ্নে সে সময়ের পুলিশ মহাপরিদর্শক আইজি এ কে এম শহিদুল হক এর ডাকে সিলেট থেকে ঢাকায় আসেন তবারক উল্লাহ এবং তিনি ওই বিভাগের নেতৃত্বে ছিলেন। দেড় বছরের মাথায় ২০১৯ সালের বিপিএম (সেবা) পদক লাভ করেন-যা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর সে সময়ের পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ তবারক উল্লাহকে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল বিপিএম (সেবা) পদক পরিয়ে দেন। এর পরে ১৮ই আগষ্ট পুলিশ সুপার জনাব মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান।
এসময় তার সাথে মোট ২০জন পুলিশ সুপারকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিলো।একাধিক সূত্রের দাবি,জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ও তিনি তৎকালীন সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নে সক্রিয় ছিলেন।
পুলিশ বাহিনীর অভ্যন্তরের বক্তব্য অনুযায়ী,যোগ্যতা, সততা ও জ্যেষ্ঠতাকে উপেক্ষা করে বছরের পর বছর তদবিরনির্ভর কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক সৎ ও মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা বারবার বঞ্চিত হয়েছেন, আর প্রশাসনের নিরপেক্ষতা গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলেই সুবিধাবাদী কম নয়। যারা সময়-সুযোগ বুঝে রং বদলায়, তারা কখনোই প্রকৃত পেশাদার হতে পারে না। শুরুতেই রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সরিয়ে না দেওয়ায় প্রকৃত সংস্কারের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।সব মিলিয়ে,বিদায়ী সরকারের আমলে পুলিশ প্রশাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল,তা এখনও ভাঙা যায়নি। ডিআইজি এহসানুল্লাহর পলায়ন এবং মোহাম্মদ তবারক উল্লাহকে ঘিরে ওঠা অভিযোগগুলো স্পষ্ট করে দিচ্ছে-প্রকৃত সংস্কার ছাড়া দমন–নীতির পুরোনো ছায়া আরও দীর্ঘ হতে পারে।
সারদা পুলিশ একাডেমির বর্তমান প্রিন্সিপাল হলেন জনাব মোঃ তওফিক মাহবুব চৌধুরী বিপিএম-সেবা (অতিরিক্ত আইজিপি)।সারদায় কর্মরত এক পুলিশের কর্মকর্তা জানান,সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে পুলিশ অফিসার নিখোঁজ,বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তিনি এতো খারাপ পুলিশ হলে ১৪ মাস চাকরিতে পদায়ন থাকতেন না। তার হারিয়ে যাবার বড়ই রহস্য রয়েছে সেটা ধামাচাপা দিতেই কি সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল জনাব মোঃ তওফিক মাহবুব চৌধুরীসহ কতৃপক্ষ তাকে উধাও বা পালিয়ে গেছে বলা হচ্ছে? এই কর্মকর্তা ধারনা করছেন নাকি এই অফিসার ও মবের শিকার হলো। আর সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে ডিআইজি নিখোঁজ হয়ে গেলো তাহলে সারদা পুলিশ একাডেমির সবাইকে কেন এখনো বরখাস্ত করা হয়নি?
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন ও লজিস্টিকস) মোহাম্মদ তবারক উল্লাহর সঙ্গে সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডিআইজি এহসানুল্লাহকে পালাতে সহায়তা করা এবং তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বিপিএম পদক পাওয়া নিয়েও তিনি প্রথমে অস্বীকার করেন; তবে তার পদকপ্রাপ্তির ছবি দেখালে বিষয়টি স্বীকার করেন। চাকরি বাণিজ্যের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রথমে এড়িয়ে গেলেও পরে তিনি অর্থের বিনিময়ে নয়, বরং কিছু রিকশাচালক ও গরিব পরিবারের সদস্যদের পুলিশে চাকরি দেওয়ার কথা সকলের সামনে স্বীকার করেন।
ডিআইজি এহসানুল্লাহ বরিশালে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বেশ কয়েকটি বিতর্কিত অভিযানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন; যা নিয়ে গত বছরের ৫ অগাস্টের পর মামলা হয়। তবে এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও বিবৃতি পাওয়া যায়নি।অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে উঠে আসা আরও গুরুতর অভিযোগের বিস্তারিত সংবাদ আগামী পর্বে প্রকাশ করা হবে।-পর্ব ১