লড়াই, সংগ্রাম আর মুক্তিতে অদম্য মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জীবনভর পরাধীন বাঙালির জাতির মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছেন। কখনোই এক মুহূর্তের জন্য আপস করেননি। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নানা পর্বে তিনি সব মিলিয়ে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। এরমধ্যে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ আমলে ৭ দিন আর বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন কারাভোগ করেন পাকিস্তান আমলে। গোটা জীবনে প্রায় ১৩ বছর কারাবন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তাঁর নিজের লেখা কারগারের রোজনামচা বই ও আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন খোকা নামে। খোকার শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়।
প্রথম কারাবাস: ১৯৩৮ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ। সে বছর গোপালগঞ্জ হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে সহপাঠী বন্ধু আবদুল মালেককে মারপিট করা হলে শেখ মুজিবুর রহমান সেই বাড়িতে গিয়ে ধাওয়া করেন। সেখানে হাতাহাতির ঘটনায় হিন্দু মহাসভার নেতাদের করা মামলায় মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তার বয়স ২০ বছরেরও কম। সেই মামলা গ্রেফতার হয়ে ৭ দিন কারাবাসের পর মীমাংসার মাধ্যমে মামলা তুলে নিলে তিনি মুক্তি পান।
১৯৪১ সালে অল বেঙ্গল মুসমিল ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা শাখার সহ-সভাপতি থাকাবস্থায় বক্তব্য দেয়া ও গোলযোগের সময় সভাস্থলে অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে দু’বার সাময়িকভাবে গ্রেফতার করা হয়।
পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত শেখ মুজিব কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় দীর্ঘ ১৩২ দিন কারাভোগ করেন তিনি। ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল তাঁকে আবারও কারাগারে নেয়া হয় এবং ৮০ দিন কারাভোগ করে ২৮ জুন মুক্তি পান। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন ও ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন শেখ মুজিব।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করার পরও বঙ্গবন্ধুকে ২০৬ দিন কারাভোগ করতে হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর ১১ অক্টোবর আবার গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। এসময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন কারাবন্দি ছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় ১৫৮ দিন কারাভোগ করেন।
১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে শেখ মুজিব ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন। বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা প্রস্তাব দেয়ার পর তিনি যেখানেই সমাবেশ করতে গিয়েছেন সেখানেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই সময়কালে তিনি মোট ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তিনি কারামুক্ত হন। এসময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাবাসে ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে। তাকে সামরিক জিপে তুলে নেয়া হয় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সেই রাতে তাঁকে আটক রাখা হয় তৎকালীন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, বর্তমান শহীদ আনোয়ার উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে। পরদিন ২৬ মার্চ তাকে ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে নেয়া হয় এবং সেখান থেকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে বিমানে করাচি নেয়া হয়।
পাকিস্তানের কারাগারে ২৮৮ দিন বন্দি ছিলেন শেখ মুজিব। পাকিস্তানের কারগারে বন্দি থাকাকালীন ৪ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। তাঁকে রাখা হয় লাহোর থেকে ৮০ মাইল দূরের লায়ালপুর শহরের একটি নির্জন কারাগারে। ১৫ ডিসেম্বর তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কারাগারের পাশে রাতে তিন কবর খোঁড়ার আওয়াজ পেতেন। পরের দিন ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোর ৩টায় মুক্তি পান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, ইতিহাসের বরপুত্র জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে ও ড. কামাল হোসেনকে তুলে দেয়া হয় যুক্তরাজ্যগামী পাকিস্তানের চার্টার্ড বিমানে। সকাল সাড়ে ৬টায় তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছান। ৯ তারিখ রওনা দেন দেশের উদ্দেশে, ১০ তারিখ এসে পৌছান দিল্লি, সেখান থেকে ফিরেন সদ্য-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে।