নির্বাচন না করা ও সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কাজী কামাল।
এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি যা লিখেছেন
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম আমার প্রিয় মাগুরা ২ নির্বাচনী এলাকার ত্যাগী কর্মী ও নেতৃবৃন্দ এবং প্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষী ভাই ও বোনেরা।
আজ আমি বুকের ভেতরে দীর্ঘদিন জমে থাকা কিছু কথা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।২০০৮ সালের পর থেকে আমি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলাম।২০১৭ সালে একটি মিথ্যা মামলায় আমাকে কারাবরণ করতে হয়। দীর্ঘ কারাবাস শেষে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর অসুস্থ শরীরে ২২শে আগস্ট ২০২৪ আমি কারাগার থেকে মুক্তি পাই।
মুক্তির দিন আপনাদের যে আবেগ ভালোবাসা আর চোখের পানি দেখেছি তা আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে।
মুক্তির পরও দীর্ঘদিন আমি মাগুরায় আসিনি। পরে মোহাম্মদপুরের নেতৃবৃন্দের অনুরোধে মোহাম্মদপুরের সংবর্ধনায় অংশ নিই। এরপর আড়পাড়া, সিংড়া ও শত্রুজিৎপুরের সংবর্ধনায় যোগ দেই। গত ১৬ মাসে এই চারবারই আমার মাগুরায় আসা। প্রতিবারই আপনাদের চোখে আমি শুধু ভালোবাসা নয় ১৬ বছরের জমে থাকা কষ্ট ও বেদনা দেখেছি।
গত ১৬ বছর আপনারাই অবর্ণনীয় জুলুম মামলা হামলা জেল ও নির্যাতন সহ্য করে মাগুরার মাটিতে বিএনপির পতাকাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
আজ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রশ্ন করতে হচ্ছে যাদের জন্য আপনারা জীবন বাজি রেখে রাজনীতি করেছেন সেই দলীয় হাই কমান্ডের কাছে কি তৃণমূল নেতাকর্মীদের আবেগ ও অনুভূতির কোনো মূল্যই নেই।
ফেব্রুয়ারি ২০২৬ সালের নির্বাচনের জন্য মাগুরা ২ আসনে দল যখন প্রাথমিক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে তখন তৃণমূলের মধ্যে যে বিস্ফোরণ ঘটে তা হঠাৎ নয়, তা ছিল দীর্ঘদিনের অবহেলা ও বঞ্চনার ফল।
মাগুরা ২ আসনের ৫১৩ জন দায়িত্বশীল নেতার মধ্যে ৫০১ জন, ১৯টি ইউনিয়নের ১৮ জন সাবেক চেয়ারম্যান এবং দুই জন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান যখন একটি সিদ্ধান্তের বিপক্ষে লিখিত প্রতিবাদ জানান তখন আমরা আশা করেছিলাম দল নিশ্চয়ই তাদের কথা শুনবে। আমরা ভেবেছিলাম রাজপথের ত্যাগী কর্মীদের দীর্ঘ ১৬ বছরের ত্যাগের অন্তত কিছু মূল্যায়ন হবে। এটা কোনো ব্যক্তিগত বিরোধ ছিল না এটা ছিল অবহেলিত তৃণমূলের আর্তনাদ।
আপনাদের এই আপত্তির মূল কারণ ছিল গত ১৬ বছর যারা হামলা মামলা জেল ও অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে দলকে আগলে রেখেছেন সেই ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন। ছাত্রদল যুবদল থেকে উঠে আসা পরীক্ষিত নেতাদের সরিয়ে বিতর্কিতদের পুনর্বাসন এবং সুকৌশলে দলের আদর্শিক বিচ্যুতি ঘটানোর প্রচেষ্টা আপনারা মেনে নিতে পারেননি।
অনেক নেতাকর্মীর আশঙ্কা বর্তমান মনোনয়নে দলের দীর্ঘদিনের আদর্শিক ভিত দুর্বল হতে পারে। এছাড়াও কিছু প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতাকর্মীর আশঙ্কা ছিল বর্তমান ইসলামিক জাগরণের প্রেক্ষাপটে একজন হিন্দু প্রার্থীকে মনোনয়ন দিলে আমাদের বহু ধর্মভীরু ভোটার জামায়াতে ইসলামির দিকে ঝুঁকে যেতে পারে যা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হবে।
কারণ এই নির্বাচন আসল নির্বাচন নয় যেহেতু এখানে আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই, ভবিষ্যতে যখন তারা নির্বাচনের মাঠে নামবে তখন আমাদের অবস্থান কী হবে এটিই ছিল তৃণমূল নেতাদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ।
দুঃখজনক সত্য হলো এই বিপুল সংখ্যক তৃণমূল নেতাকর্মীর মতামতের কোনো মূল্যই দেওয়া হয়নি। তাদের হাহাকারকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নেতাকর্মীদের ডেকে কথা শোনা হয়নি বোঝার চেষ্টা করা হয়নি, এমনকি সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করা হয়নি। এই একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে।
যারা গত ১৬ থেকে ১৭ বছর মামলা হামলা জেল নির্যাতন ও বঞ্চনা সহ্য করে দল আগলে রেখেছেন আজ তাদের মনে এই প্রশ্ন জাগে আমাদের ত্যাগের কোনো মূল্য কি আদৌ আছে।
দলের হাই কমান্ডের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই এভাবে একতরফা সিদ্ধান্ত নিলে দল শক্তিশালী হয় না।
তৃণমূলই দলের প্রাণ। যখন হাজার হাজার ত্যাগী কর্মীকে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন দল শক্তিশালী না হয়ে ভেতর থেকে ক্ষয়ে যায়। এই অবহেলার ফলে যদি মাঠপর্যায়ের কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে তবে এর দায়ভার কে নেবে। এটাই দলের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি।
ত্যাগীদের বাদ দিয়ে বিতর্কিতদের পুনর্বাসনের এই সংস্কৃতি দলকে ভবিষ্যতে এক ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। আজ নেতাকর্মীরা আতঙ্কিত আগামীতে তারা আদৌ নিরাপদ থাকবে কি না নাকি স্বার্থান্বেষী মহলের তাণ্ডবের শিকার হবে।
আমি আপনাদের এই দীর্ঘশ্বাস ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে বুঝি। আমি এই কষ্ট অনুভব করি। আমি জানি এই অবহেলা নেতাকর্মীদের ভেতরে কতটা হতাশা ও রাগ সৃষ্টি করেছে।
আড়পাড়ার প্রতিবাদ সভায় আমি শুধু দলের স্বার্থে বলেছিলাম দল যেন তৃণমূলের কথা শোনে এবং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে। আমি বলেছিলাম আমাকে নয় অন্য যেকোনো যোগ্য কাউকে দিলেও তৃণমূল মেনে নেবে।
আপনারা আমাকে ভালোবেসে যে সম্মান দেখিয়েছেন আমি তার কাছে আজীবন ঋণী। আপনাদের চাপে আমি স্বতন্ত্রভাবে লড়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম। কিন্তু দলের বর্তমান অনড় ও একতরফা অবস্থান দেখে আমি বুঝতে পারছি এখানে তৃণমূলের যুক্তি বা আবেগের কোনো জায়গা নেই।
নেতাকর্মীদের মনে গভীর ক্ষোভ জমে আছে। তবু আমি অনুরোধ করব এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আপনার নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তরুণদের সামনে রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। একটি ভুল সিদ্ধান্তে সেই সুযোগ নষ্ট করবেন না।
দীর্ঘ সাত বছর কারাবাসে আমার পরিবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবারের একান্ত অনুরোধে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি আর কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে চিরতরে অবসর গ্রহণ করছি। জীবনের বাকি সময়টুকু পরিবার নিয়ে শান্তিতে কাটাতে চাই।
তারুণ্যের জয় হোক, আপনারা এগিয়ে যান। তবে মনে রাখবেন কর্মীদের চোখের পানি কখনো দলের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। যারা দলের খুঁটি তাদের অবজ্ঞা করে কোনো নেতৃত্বই বেশিদূর যেতে পারে না।আপনাদের এই ত্যাগ ও ভালোবাসা আমার হৃদয়ে আজীবন গেঁথে থাকবে। আল্লাহ আপনাদের সবাইকে এই কঠিন সময়ে ধৈর্য ধারণের শক্তি দান করুন।
তৃণমূল জিন্দাবাদ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জিন্দাবাদ