বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের মনোজগত। তৈরী হচ্ছে নানাবিধ নতুন নতুন মানসিক সমস্যা। দিনকে দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে এ সমস্যাগুলো। হতাশা, নিরাশা, আতংক আর বিষন্নতার চাঁদরে ক্রমশ: আচ্ছাদিত হয়ে পড়ছে আমাদের সবারই মনোদৈহিক অবস্থা। তার প্রতিফলন ঘটছে আমাদের দৈনন্দিন আচরণে-ব্যবহারে। তাই আজ সাধারন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই লিখছি।
বয়স ও পেশাভিত্তিক এই মানসিক সমস্যাগুলো আবার ভিন্ন ভিন্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। যেমন –
১. বড়দের মানসিক সমস্যা
২. বয়স্কদের মানসিক সমস্যা
৩. শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা
৪. পেশাজীবীদের মানসিক সমস্যা
উল্লেখ্য বিষয়টির গুরুত্ত্ব অনুধাবন করে অনেকদিন ধরে এ বিষয়ের উপর লিখতে চেয়েছি। আজ শুরু করলাম। তবে উপরের ৪ শ্রেণীর মানুষের উপর আলাদা আলাদা করে লিখতে যেয়ে লেখার কলেবর একটু বড় আকার ধারণ করায় সেটাকে ৪টি পর্বে ভাগ করে পরপর ৪দিনে পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যাতে পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি না ঘটে। তবে আমার কাছে প্রতিটি পর্বই খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তাই সব পর্বগুলো পাঠান্তে পাঠককুলের উপকারে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। আজ ১ম পর্ব শুরু হলো।
১. বড়দের মানসিক সমস্যা:
কি ধরনের সমস্যা হতে পারে?
মূলত: বাড়ির অভিভাবক তিনি। পরিবারের সকল দায়দায়িত্ব তার ঘাড়েই ন্যাস্ত। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ সকলের সুখ-দূ:খের ভার তাকেই বহন করতে হয়। তাই এই দূর্যোগ পরিস্থিতিতে তার উপরে মানসিক চাপটাও কম নয়। করোনার প্রকোপ কবে যে কাটবে এই অনিশ্চয়তাও মানসিক চাপের আরেকটা কারন।
প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চটকদার খবর ও গুজবে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে ক্রমশ:ই। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও মানেও যথেষ্ট তারতম্য ঘটছে। বাজার-ঘাট, কেনাকাটা, স্বাভাবিক চলাফেরায় বিশেষ নিষেধাজ্ঞা ও সুরক্ষার খড়গ, জরুরী প্রয়োজন মিটানোর ঝামেলা-সবকিছুতেই কঠোর নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি কারনগুলোও মানসিক সমস্যা তৈরীতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখছে বলে মানোরোগ বিশেষজ্ঞগন মনে করছেন।
তাহলে সমাধানের উপায় কি?
# অযথা প্যানিক না হয়ে সর্বদা লেটেস্ট খবর জানার চেষ্টা করুন তবে সীমিত আকারে। সব সময় খবরের মধ্যে ডুবে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আবার অহেতুক গুজবে কান না দেওয়াই উচিৎ। খবরের সত্যতা যাচাই করুন। ইতিবাচক খবর জানার চেষ্টা করুন। কতজন মারা গেছে না জেনে বরং কতজন স্বুস্থ্য হয়ে উঠলো সেটাও জানুন। তাতে মনের মধ্যে এক ধরনের শক্তি পাবেন।
# জীবনকে করোনাময় করে তুলবেন না। এই ক্রান্তিকালের সাথে তাল মিলিয়ে রুটিনমাফিক জীবনকে পরিচালিত করুন। প্রতিদিনই বাজার না করে সপ্তাহে একদিন তালিকা করে সুরক্ষা মেনে বাজার করে আনুন। জরুরী কেনাকাটা-যেমন-ওষুধ ও অন্যান্য জরুরী সামগ্রী প্রয়োজন অনুসারে একসাথে অনেকটা কিনে রাখুন। তাতে মানসিক চাপটাও অনেকাংশে কমে আসবে।
# স্বাস্থ্যবিধি নিজে ও পরিবারের সবাইকে মেনে চলার দিকে লক্ষ্য রাখুন। যেমন –
* স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার গ্রহন এবং সময়মত খাওয়া-দাওয়া করা।
* হাল্কা/ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করা।
* টাইমলি ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠা। অধিক রাত না জাগা।
* যেকোনো অসুখের পূর্ব লক্ষনে প্রথম থেকেই সতর্ক হোন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন।
# পারিবারিক কাজে নিজে সময় দিন। যেমন –
* রান্নার কাজে হেল্প করতে পারেন।
* মাছ-মাংস,তরকারি কাটায় হেল্প করা যায়।
* নিজেই রান্নার নতুন কিছু আইটেম তৈরী করতে পারেন।
* ঘর-দোর গোছানো/মুছানো।
* জামা-কাপড় কাচা/আইরন করা।
# পরিবারের সদস্যদের সাথে কোয়ালিটিটিভ সময় ব্যয় করুন। যেমন –
* তাদের সাথে একসাথে বসে সময় কাটানো, গল্প-গুজব করা।
* কুরআন-হাদীস থেকে শিক্ষা দেওয়া, সহীহ কুরআন শিক্ষা করানো, নৈতিক গল্প শোনানো, পারিবারিক আলোচনা করা ইত্যাদি।
* একসাথে জামায়াতে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করুন। তাতে পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষাটাও পেয়ে যাবে পরিবারের সদস্যরা।
* একসাথে টিভিতে খবর/নাটক দেখা, ইউটিউব/সিডিতে শিক্ষণীয় জিনিসগুলো দেখা, ইনডোর গেম-লুডু বা অন্যান্য মজার খেলায় মেতে ওঠতে পারেন। তাতে সময়টা ভালোই কাটবে বৈকি।
* পরিবারের সদস্যদের সাথে খারাপ আচরণ না করাই উচিৎ। এ সময়ে যেকোনো পারিবারিক মনোমালিন্য সর্বদা পরিতাজ্য।
# পরিবারের সদস্যদের চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখুন ও সেটা পুরন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করুন। না করতে পারলে সুন্দর করে বয়সভেদে বোঝানোর চেষ্টা করুন।
# মাদক বা ধুমপানমুক্ত থাকুন। মনে রাখতে হবে করোনায় কিন্তু ধুমপায়ীরাই বেশী ঝুঁকিতে আছেন।
# করোনায় আক্রান্ত আত্মীয়-স্বজনদের খোজ খবর রাখুন এবং তাদেরকে যথাসম্ভব হেল্প করার চেষ্টা করুন। এছাড়া তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতাটুকু জেনে রাখুন যেটা পরবর্তিতে আপনার কাজে লাগতেও পারে।
# প্রয়োজনীয় টেলিফোন নাম্বারগুলো হাতের কাছে সংগ্রহে রাখুন। যেমন –
* হাসপাতাল
* ডাক্তার
* স্বাস্থ্যকর্মী
* পরীক্ষা করানোর ল্যাবরেটরি
* অক্সিজেন সিলিন্ডার
*এম্বুলেন্স/রেন্ট এ কার
বিশেষকরে যারা করোনার কাজে নিয়োজিত তাদের নাম্বারগুলো তো বটেই। এতে জরুরী মুহুর্তে মনোবল অটুট থাকবে। হঠাৎ করে ঘাবড়ে যাবার সম্ভাবনা কমবে।
# এছাড়া অনলাইনে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নেবার অসংখ্য মাধ্যম রয়েছে। তাদের সাথেও যুক্ত হয়ে থাকতে পারেন এবং জরুরী প্রয়োজনে এটা খুবই কাজে আসবে। এতে মানসিক চাপটাও কমবে বৈকি৷
লেখকঃ
ডা. এহসানুল কবীর
সহকারী অধ্যাপক,
সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা।