প্রথম ফসল গেছে ঘরে/ হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল/অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/বাঁশ পাতা মরা ঘাস-আকাশের তারা/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা/ ধানক্ষেতে মাঠে-জমিছে ধোঁয়াটে/ধারালো কুয়াশা/ঘরে গেছে চাষা/ঝিমায়াছে এ- পৃথিবী” হেমন্ত নিয়ে কবি জীবনানন্দ এমনই বর্ণনা তুলে ধরেছেন তাঁর পেঁচা (মাঠের গল্প) কবিতায়। বাংলার প্রকৃতিতে যোগ হচ্ছে সেই হেমন্ত কাল। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস মিলে হেমন্ত কাল। শরতের পরে আর শীতের আগে এ ঋতু এখন যেন কাগজে ঋতুতে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে এ ঋতুর আবেশ বাঙ্গালীর ঐতিহ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেকটা হারিয়েও গেছে। ফলে হেমন্ত এখন কেবল কাগুজে ঋতুতে পরিণত হয়েছে।বাংলাদেশ উৎসবের দেশ। বারো মাসে তের পার্বণ। এটি ছিল বাঙ্গালীর একটি অন্যতম ঐতিহ্য। প্রচলিত উৎসবের মধ্যে নবান্ন উৎসব ছিল অন্যতম। হেমন্তকালে এ উৎসব ছিলো সার্বজনীন। নবান্ন ঘিরে (নতুন ধান ঘরে তোলা উৎসব) গ্রামে গ্রামে চলত পিঠা-পুলি ও খির-পায়েশের উৎসব। হেমন্তে ধান কাটা উৎসবে যোগ হতো সারি সারি গরু ও মহিষের গাড়ি। মাঠে মাঠে কৃষকরা দল বেধে ধান কাটা উৎসবে যোগ দিতেন। আর গেয়ে উঠতেন জারি-সারি ভাটিয়ালিসহ নানা ধরনের গান। এক কোথায় গ্রামীণ জীবনে হেমন্তের আবহ ছিল অন্তপ্রাণে গাঁথা।
হেমন্তে এখন উৎসব যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামের পিঠা এসে যোগ হয়েছে শহরের হোটেল ও ফাস্ট ফুডের দোকানে। পিঠা উৎসবও এসে যোগ হয়েছে শহরের মেলা প্রাঙ্গণে। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ঐতিহ্য থেকে। হেমন্তে ধান কাটা উৎসবে আর দেখা মেলে না সারি সারি গরু ও মহিষের গাড়ি। এখন সেখানে যোগ হয়েছে ইঞ্জিন চালিত যান বা রিকশা ভ্যান। কিন্তু এখন আর সেই ঐতিহ্য নাই।
ডুমুরিয়ার রুপরামপুর মনোজিৎ বালা বলেন, ‘কার্তিকে আগে অনেক মানুষ না খেয়ে থাকত। নতুন ধান উঠলে সেই কষ্ট দূর হত। নতুন ধানের আলো চাল ও সেই চালের আটা দিয়ে মুড়ি-মুড়কি, খৈ, পাটিসাপ্টা, ভাপা পিঠা, পায়েশসহ নানা ধরনের পিঠার আয়োজন হত। এখন আর হয় না। কিন্তু এখন আর না খেয়ে কাউকে থাকতে দেখি না। সবাই অন্তত তিন বেলা খেতে পারছে। এটা দেখে খুব ভালো লাগে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অগ্রহায়নে শীতের সকালে খেজুর রসের সঙ্গে দুমুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে কৃষক নেমে পড়ত কাজে। এখন সেখানে যোগ হয়েছে ভাত বা রুটি। পেট পুরে খেয়ে-দেয়ে মানুষ অনেক বেলা করে উঠেও দেখি কাজে বের হয়।’
রংপুর কলেজের প্রভাষক ননী গোপালের বলেন, ‘একসময় কার্তিক মাসে আশ্বিনের স্বল্প-উৎপাদনশীল আউশ ধান চাহিদার তুলতায় অনেক কম পেতেন কৃষকরা। কিন্তু এখন সেখানে যোগ হয়েছে উচ্চ ফলণশীল জাতের নানা ধরনের ধান। ফলে এখন কোনো কোনো এলাকায় ছোট ছোট আকারে কার্তিকের শুরুতেই ধান কাটার মাধ্যমে নবান্ন উৎসব দেখা গেলেও আগের সেই যৌলুস যেন নাই। আবার অগ্রহায়ণে একমাত্র আমনের একসময় বাঙ্গালী কৃষকদের ভরসা থাকলেও এখন প্রায় সারা বছরই উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উৎপাদন হচ্ছে। ফলে ধান কাটা ঘিরে গ্রামীণ উৎসব এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। যাতে করে পিঠা,পুলির আসরও তেমন বসছে না। সেইসব আসর শীতে শহরের বিভিন্ন মেলা প্রাঙ্গনে এসে যোগ হয়েছে।
আর শহরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা ফাস্ট ফুডের দোকানে সারা বছর মিলছে পাটিসাপটা-পুলি পিঠা। শীতে শহরের মোড়ে মোড়ে বিক্রি হয় এখন ভাপা পিঠা। যা আগে হেমন্ত কালে খেজুরের নতুন গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেতেন বাঙ্গালী। নবান্ন উৎসবে যোগ দিতে দাওয়াদ দিয়ে খাওয়ানো হতো আত্মীয়-স্বজনকে। মেয়ে-মেয়েজামাই, নাতি-নাত্নিতে ভরে উঠতো কৃষকের ঘর।’