উপমহাদেশের প্রখ্যাত বংশীবাদক, বাঁশীর যাদুকর ও ফোক গানের ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতজ্ঞ, গীতিকার, সুরকার বরেণ্য সংগীত শিল্পী বারী সিদ্দিকীর বুধবার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। নেত্রকোনাবাসী তাকে মরোত্তর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক প্রদান, জন্ম এবং মৃত্যুবার্ষিকী সরকারিভাবে উদ্যাপনসহ বাউল বারী সিদ্দিকী ইন্স্ট্রিটিউট নির্মানের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবী করেছেন।
জানা গেছে, নেত্রকোনার কৃতিসন্তান বারী সিদ্দিকী সদর উপজেলার মৌগাতী ইউনিয়নের ফচিকা গ্রামের সংগীত অনুরাগী পরিবারে ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ এবং ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মাতা ছিলেন গ্রামীণ গীত গানের স্বনামধন্য গায়ক, ১২ বছর বয়সে নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে তিনি সংগীত তালিম নেন। বারী সিদ্দিকীর সহধর্মিনী থানপুরা বাদক, একমাত্র মেয়ে কন্ঠশিল্পী এলমা সিদ্দিকী বাউল, ইংলিশ ও হিন্দি গানে পারদর্শী, বড় ছেলে সাব্বির সিদ্দিকী চলচ্চিত্র অভিনেতা, ছোট ছেলে বিলাস সিদ্দিকী কন্ঠশিল্পী ও গীটার বাদক, সহোদর বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আবুল হাসেম ছিলেন বিশিষ্ট যাত্রা অভিনেতা। বারী সিদ্দিকী ওস্তাদ আমিনূর রহমান, দবির খাঁ, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর সান্নিধ্য লাভ করেন, পরে ক্লাসিক্যাল মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করেন, এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত বংশীবাদক হয়েও উচ্চাঙ্গ সংগীতেও প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতে পূনেতে ভিজি কার্ণাডের কাছে তালিম নেন বাঁশীর যাদুকর বারী সিদ্দিকী। দেশে ফিরে লোকগীতির সঙ্গে ক্লাসিক মিউজিকের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।
তিনি গ্রামীণ লোকসংগীত ও আধ্যাত্নিক অর্থাৎ ভাবধারার গান গেয়েছেন। তাঁর গাওয়া বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে চোয়া চান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমায়ছ নাকি, আমার মনে যত কষ্ঠ সয়, চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তত বড়, পূবালী বাতাসে চায়া থাকি আমার নাকি কেও আসে, রজনী হইস না অবসান আজ নিশী রাইতে আসবে আমার বন্ধু কালাচন, আমি নষ্ঠ মানুষ তবুও কেন এতো ভালোবাসা (শিল্পীর সহধর্মিনীকে নিয়ে গাওয়া গান), কেহ গরীব টাকার লাইগিয়্যা কেহ গরীব রূপের লাইগিয়্যা আমি গরীব ভালোবাসর লাইগিয়্যা এই দুনিয়ার সবাই গরীব কান্দে কান্দে চুপে চুপে, মওলা আমার বাড়ী নিয়া নেরে মওলা আমার গাড়ী নিয়া নেরে মওলা আমার সব নিয়া নেরে, আমার ভালোবাসার মানুষ দিয়া দেয় রে, আমি একটা জিন্দালাশ কাটিছ নারে জংলার বাঁশ আমার সাড়ে তিন হাত কবর লাইগিয়া আমার আছে বাঁশেরও বাঁশী, তুমি আইয়্য-আইয়্য পরাণের বন্ধু আমার বাউল বাড়ীতে (এই গানটি শ্রদ্ধেয় শিল্পী তাঁর একমাত্র মেয়ে কন্ঠশিল্পী এলমা সিদ্দিকীর জন্য লিখে ছিলেন। গুণী এই শিল্পী স্থানীয় মহাদেবপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া-লেখা শেষে ৮ম শ্রেণিতে জেলা শহরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ইংরেজী বিষয়ে ১শত মার্ক পেয়ে এসএসসি পাস করেন তারপর নেত্রকোনা সরকারি কলেজ হতে বিএ পাস করেন এবং দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইসলামের ইতিহাসে এমএ পাস করেন।
শিল্পী বারী সিদ্দিকী প্রবাস প্রজন্ম জাপান অ্যওর্য়াড, কাল্চারাল নাইট সিডনি টাওয়ার বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব এনএসডব্লউ মিউজিয়ান অ্যওয়ার্ড, বেলারুস হিন্দু ইউনিভার্সিটি মিউজিশিয়ান অ্যওয়ার্ড, মহাত্নাগান্ধী অ্যওয়ার্ড ভারত, জেনেভা ওয়ার্ল্ড ট্রুথ মিউজিশিয়ান কনফারেন্স অ্যাওয়ার্ড, মালয়েশিয়া কুয়ালামপুরে ক্ল্যাসিকেল মিউজিক মেস্ট্রুস অ্যওর্য়াড (ভারত-বাংলাদেশ যৌথ চেম্বার কর্মাস ইন্ড্রাস্ট্রি), সংবর্ত-এঁর একক বংশীবাদন পদক, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র অ্যওর্য়াড বাংলাদেশ, জাতীয় প্রেসক্লাব পদক, ওয়ার্ল্ড ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ অ্যওয়ার্ড, ফোক গান ফ্যাষ্টিভাল বাংলাদেশ সেরা অ্যওর্য়াড, মাদার ফাউন্ডেশন পদক-মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর ছায়াপথ সাংস্কৃতিক সংগঠনের বর্ষাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পদক, ভাটই মাধ্যমিক বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক পদক-ঝিনাইদহ, বাঙলা ঢোল প্যাজেন্ট পদক, বরগুনা মণি সংগীত বিদ্যালয়ের সংগীত সাধক গুরু গোপী মোহন কর্মকার পদক, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক ও বরেণ্য সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পদকসহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য পদকে ভূষিত হয়েছেন।
নবনাট্য সংঘ বাংলাদেশ নেত্রকোনা জেলা শাখার সভাপতি সালাহ্উদ্দিন রুবেল জানান, শ্রদ্ধেয় প্রয়াত বারী সিদ্দিকী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেলে নেত্রকোনা সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন, শিল্পীর মনের ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজ হাতে গড়া বাউল বাড়িতে তৈরী হবে বাউল ইনষ্টিটিউট, যেখানে বাউল গানের চর্চা হবে এবং তৈরী হবে বাউল শিল্পী পাশাপাশি বাঁশীর সুরের গবেষণা হবে। কিন্তু তাঁর অকাল প্রয়াণে সকল কিছুই ধোঁয়াশা। বিশেষ করে সরকারের নিকট জোর-দাবি রাষ্ট্রিয় পদক যেন তাঁকে মরোত্তর প্রদান করা হয়।
প্রয়াত বারী সিদ্দিকীর স্ত্রী পারভিন সিদ্দিকী জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হলো না। মৃত্যুর পর অনেকেই অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সরকারী বেসরকারী সহযোগীতার কিন্তু কিছুই আর বাস্তবায়িত হয়নি। তাই সরকারের কাছে আবেদন প্রয়াত এই শিল্পীর মনের যে স্বপ্ন ছিল এই বাউল বাড়ীকে ঘিরে তা যেন বাস্তবায়ন করা হয়। জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার অমল বোস জানান, জেলা প্রশাসনের উদ্দ্যেগে সন্ধ্যা ৭টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমীর হলরুমে শ্রদ্ধেয় বারী সিদ্দিকীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মরণসভা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তিনিই একমাত্র শিল্পী যে ফোক গান কে ক্ল্যাসিক্যাল গানে রূপান্তির করেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে আমরা আরও অনেক কিছু শিখতে পারতাম।