রাজধানীর গণপরিবহণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার ফলে গণপরিবহণের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। এরপরও রাজধানীতে অধিকাংশ গণপরিবহণেই আদায় হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চালক-হেলপারের বাগবিতন্ডা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায় করা হলে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন খোদ সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী। পরিবহণ মালিক শ্রমিকদের ‘ভিজিলেন্স টিম’ প্রতিদিনই তদারকি করছে বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে। বিআরটিএ ও সরকারের একাধিক সংস্থা বাস ভাড়ার চার্টের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা ও বাস ডাম্পিংয়ে পাঠানোর মতো ঘটনায়ও পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকদের লাগাম টানতে পারছে না। এদিকে ১ ডিসেম্বর থেকে বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার ঘোষণা এখনো অধিকাংশ পরিবহণ মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। অর্ধেক ভাড়া তদারকিতে মঙ্গলবার থেকে মাঠে নেমেছে পরিবহণ মালিক সমিতির ৯ ভিজিলেন্স টিম। যাত্রীদের অভিযোগ, বাসে লাগানো সরকার নির্ধারিত তালিকা থেকেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে পরিবহণ-সংশ্লিষ্টরা। তালিকা অনুযায়ী, কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া আদায় করার কথা থাকলেও অধিকাংশ বাসে সেটা মানা হচ্ছে না। বাসচালক-স্টাফদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভাড়া আদায় হচ্ছে।বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করতে গত ৭ নভেম্বর বিআরটিএ’র রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি ঢাকা মেট্রো এলাকায় ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। তালিকায় প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ২.১৫ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারণের এক মাস অতিবাহিত হলেও এখনো গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস মালিকদের সংগঠনগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারের কর্মকর্তারা জড়িত। তাদের ইচ্ছা অনুয়ায়ী গণপরিবহণে ভাড়ার নৈরাজ্য চলছে। সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করলে গণপবিহণ বন্ধ করে ধর্মঘট পালনের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। সড়কে বাসচালক ও হেলপারদেরে দিয়ে বাস মালিকরা যাত্রীদের পকেট কেটে ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীদের বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটিএ’র যথেষ্ট জনবল নেই। প্রতিদিন ৫-৬ হাজার গণপরিবহণ ঢাকায় চলাচল করে। অথচ বিআরটিএ ৭-৮ জন নিয়ে রাস্তায় অভিযান চালায়। শতাধিক রুটের জন্য এত অল্পসংখ্যক লোক দিয়ে গণপরিবহণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। এতে পরিবহণ মালিক শ্রমিকরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। যাত্রীদের ভোগান্তি কমিয়ে আনতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সরেজমিন জানা গেছে, পরিবহণ মালিক সমিতির নির্দেশের পরও অধিকাংশ বাস চলছে ওয়েবিল সিস্টেমে। যদিও পরিবহণ মালিক সমিতি সূত্র বরাবরই বলে আসছে, রাজধানীতে ওয়েবিল সিস্টেমে কোনো গণপরিবহণ চালানো যাবে না, সিটিং সার্ভিস চলবে না। এরপরও অধিকাংশ পরিবহণ মালিক এসব নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ওয়েবিল প্রথায় বাস চালাচ্ছে। এ ছাড়া ওয়েবিল নামধারী বাসে ছাত্রদের থেকে হাফ ভাড়া নিচ্ছে না অনেকেই। ওয়েবিলের কারণে এক কিলোমিটার রাস্তাও যেতে হচ্ছে ১০-১৫ টাকায়। কামারপাড়া থেকে চিটাগাং রোডগামী ‘মনজিল এক্সপ্রেস’, মিরপুর থেকে মহাখালী হয়ে মতিঝিলগামী ‘আল-মক্কা ট্রান্সপোর্ট’, ঘাটারচর বসিলা থেকে কামারপাড়াগামী ‘প্রজাপতি পরিবহণ’, বাড্ডা-নতুন বাজার-ধামরাই-বাথুলী রুটে চলাচলকারী ‘বৈশাখী পরিবহণ’, মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীগামী ‘শিকড় পরিবহণ’, বনশ্রী থেকে মোহাম্মদপুরগামী ‘তরঙ্গ পস্নাস’, খিলগাঁও থেকে মোহাম্মদপুরগামী ‘মিডলাইন পরিবহণ’, বাড্ডা থেকে আজিমপুরগামী ‘দেওয়ান পরিবহণ’, বনশ্রী থেকে শিয়া মসজিদগামী ‘আলিফ পরিবহণ’সহ নগরীতে চলাচলকরী বিভিন্ন রুটের বেশিরভাগ বাসেই ‘ওয়েবিলের’ দোহাই দিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। রাজধানীর অধিকাংশ বাসেই দেখা গেছে ভাড়ার তালিকা টাঙানো থাকলেও তালিকা অনুসারে ভাড়া আদায় না করে বাড়তি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। কিলোমিটার হিসাবে তালিকা প্রকাশ করা নিয়েও অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা রাখা হলেও কাছাকাছি স্টপেজগুলোতে (২-৪ কিলোমিটারের মধ্যে) অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে কন্ডাক্টররা। সরেজমিন রাজধানীর ফুলবাড়িয়া থেকে গাজীপুর রুটের বাস ভাড়ার চার্টে দেখা যায়, ৯টি স্টপেজের নাম ও ভাড়া উলেস্নখ করা হয়েছে। তালিকায় প্রায় ১০টি গুরুত্বপূর্ণ স্টপেজ উলেস্নখ করা হয়নি। ফলে এসব স্থানে ভাড়াও নির্ধারণ না করায় বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিআরটিএ’র ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) মোহাম্মদ শহীদুলস্নাহ্? ও সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল আলম সরকার স্বাক্ষরিত তালিকায় ফুলবাড়িয়া থেকে কাকরাইল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার। এতে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা। ফুলবাড়িয়া থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৪ দশমিক ২ কিলোমিটারও ১০ টাকা ভাড়া। ফুলবাড়িয়া থেকে মহাখালী পর্যন্ত ৯ দশমিক ৪ কিলোমিটার ২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও মধ্যবর্তী সাতরাস্তা ও নাবিস্কোর ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে এসব স্থানেও ২০ টাকা করে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যদিও কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া হওয়ার কথা ১৪-১৫ টাকা। গুলিস্তান থেকে কাকলী পর্যন্ত ১১ কিলোমিটারের ভাড়া ২৪ টাকা, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮ কিলোমিটারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ টাকা। মধ্যবর্তী স্থানে এমইএস, কুড়িল বিশ্বরোড ও নিকুঞ্জ- এই তিনটি স্টপেজের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে এসব স্থানের যাত্রীদের বিমানবন্দর স্টপেজের বাড়তি ভাড়ায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, সাইনবোর্ড থেকে নবীনগর রুটে বাস ভাড়ার নৈরাজ্য চলমান রয়েছে। বিশেষ করে মৌমিতা পরিবহণে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলছেই। সোমবার মক্কা পরিবহণের ব-৭৩০২ নম্বর গাড়িতে আমান নামের এক যাত্রী বলেন, সরকারের নির্ধারিত তালিকা বাসে থাকলেও সেটা মানা হচ্ছে না। বাসের কন্ডাক্টর আগের বাড়তি ভাড়ার সঙ্গে স্টপেজ অনুসারে ৫-১০ টাকা বাড়িয়ে ভাড়া নিচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু মক্কা পরিবহণই নয়, এই রুটে চলাচলকারী মনজিল, আজমেরি- সব বাসেই যাত্রীরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আরেক যাত্রী সগির হোসেন বলেন, পরিবহণ মালিকরা ঘোষণা দিয়েছেন, সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিল বন্ধ। বাস্তবে সবই চলছে। নির্দিষ্ট স্থান পরপর বাসে ওয়েবিল হয়। ওয়েবিলটি মালিক শ্রমিকদের একটা কৌশল। এই কৌশল কাজে লাগিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করতে পারছে। তারা কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া নিতে নারাজ। রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া কার্যকর করার পাশাপাশি ভাড়া আদায় পর্যবেক্ষণে ৯টি ‘ভিজিল্যান্স টিম’ সম্পর্কে মঙ্গলবার সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ মুঠোফোনে যায়যায়দিনকে বলেন, ‘বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া কার্যকর করার বিষয় এবং চার্টের বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কিনা, সেটা পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকাস্থ পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতাদের সমন্বয়ে ৯টি ভিজিল্যান্স টিম’ সম্পর্কে মঙ্গলবার সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ মুঠোফোনে যায়যায়দিনকে বলেন, ‘বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া কার্যকর করার বিষয় এবং চার্টের বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কিনা, সেটা পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকাস্থ পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতাদের সমন্বয়ে ৯টি ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের হাফ ভাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর হয়েছে। কিছু জায়গায় অল্পসংখ্যক বাসে কার্যকর হয়নি বলে আমরা অভিযোগ পাচ্ছি। এসব ভাড়া নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে সাহায্য করছি।’ বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার ভাড়া নির্ধারণ করেছে কিলোমিটার হিসাবে। আর ঢাকা মহানগরে সেটি আদায় করা হচ্ছে ওয়েবিল হিসাবে। যখন ওয়েবিল হিসাবে ভাড়া আদায় করা হয়, তখন কিলোমিটারের হিসাবে যায় না। যাত্রীরা যদি ৫ কিলোমিটার পথে যাতায়াত করেন, কখনো কখনো তাকে ১০ কিলোমিটার পথের ভাড়া দিতে হচ্ছে।’