বাংলাদেশের অন্যতম একটি স্মৃতিবহুল স্থানের নাম ঈশ্বরীপুর।এখন মূলতঃ অজ পাড়াগাঁ।সেই অজ পাড়াটি এখন সেজেছে নতুন ঢঙে। যেখানে একসময় রাজা-বাদশাদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। সেটি এখন শুধু স্মৃতিই। এখানেই ছিল যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী যার নাম ধুমঘাট ।প্রতাপাদিত্যের রাজধানীতে দীর্ঘকাল কোন নামিদামি মানুষের পদার্পণ ঘটেনি।তবে হঠাৎ করেই এই এলাকাটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।দীর্ঘদিনের নিস্তব্ধতা ভেঙে কর্মচঞ্চল হয়ে পড়েছে ঈশ্বরীপুর গ্রামটি। এই গ্রামে আগামী ২৭ মার্চ রাজার বেশে আসছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।মোদির আগমনকে ঘিরে ঈশ্বরীপুরে এখন উৎসবের আমেজ। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুরের যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে তিনি পূজায় অংশগ্রহণ করবেন ।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ৫১ সতীপীঠের অন্যতম পবিত্র স্থান।
দায়িত্বশীল সুত্র জানায়,ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে ঘিরে এখানে নেয়া হয়েছে তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা,সেনাবাহিনী, পুলিশ,র্যাব সহ বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীলরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন গোটা শ্যামনগর। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে ঈশ্বরীপুর।ঈশ্বরীপুর এ সোবহান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অসীম সাহা জানান, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমনে ঈশ্বরীপুর ধন্য। আমরা তার শুভ আগমনের প্রহর গুনছি। প্রতিদিন ঈশ্বরীপুরের আকাশে হেলিকপ্টার ওঠানামা করছে । বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ঈশ্বরীপুরে আসছেন এটি গর্বের। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে প্রস্তুত প্রতাপাদিত্যের ঈশ্বরীপুর।
এবার ইতিহাসের পাতা থেকে ঈশ্বরীপুর সম্পর্কে কিছু কথা ঃ
সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শ্যামনগর উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঈশ্বরীপুর।
ইতিহাস অনুসারে, নবাব সোলায়মানের পুত্র নবাব দাউদ শাহের স্বাধীনতার চেতনা থেকেই কালক্রমে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যশোর রাজ্যের রাজধানী। ১৫৭৩ সালে সিংহাসনে বসেন দাউদ শাহ। তার দুই বাল্যবন্ধু শ্রীহরিকে ‘বিক্রমাদিত্য’ এবং জানকিকে ‘বসন্ত রায়’ উপাধি দিয়ে তিনি তাদের মন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। বর্তমানে সুন্দরবনঘেরা এ এলাকার জলদস্যু, মগ, পর্তুগিজদের লুটতরাজ এবং অত্যাচার দমনের জন্য নবাব দাউদ শাহ বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায়কে দায়িত্ব দেন। বসন্ত রায় সাতক্ষীরায় এক গ্রামে এসে ঘাঁটি গাড়েন। এ কারণে এখানকার নাম হয় বসন্তপুর। বিক্রমাদিত্যকে দেয়া হয় অন্য এলাকার দায়িত্ব।
বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্য পিতার জীবদ্দশায় আরো একটি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেন। এ সময়ে নবাব দাউদ শাহের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় দিল্লির সম্রাট আকবরের। সম্রাট আকবর নবাব দাউদ শাহকে শিক্ষা দেয়ার জন্য বিরাট এক রণতরী ও সৈন্যবহর নিয়ে যুদ্ধে চলে আসেন। ইতিহাসবিদদের মতে, ওই নৌবহরের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং সম্রাট আকবর। সম্রাট আকবর ও নবাব দাউদ শাহের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় ‘রাজমহল’ নামক স্থানে। দীর্ঘ যুদ্ধে নবাব দাউদ শাহ পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে গোপনে তার সমুদয় ধনসম্পদ পাঠিয়ে দেন রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছে। এ বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে পরে প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরে তৈরি করেন এক বিলাসবহুল রাজধানী। এক স্থানের ‘যশ’ (সম্পদ) অন্যস্থানে এনে রাজ্য গড়ার কাহিনী লোকমুখে ফিরতে ফিরতে এ এলাকার নাম হয় যশোহর বা যশোর। রাজা প্রতাপাদিত্য নিজেকে ‘স্বাধীন রাজা’ হিসেবে ঘোষণা দেন ১৫৯৯ সালে। ১৬১২ সালে সুবেদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরে নির্মাণ করেন বহু ইমারত ও দুর্গ । বহিঃশত্রু থেকে রাজ্য রক্ষা করার জন্য তিনি মুকুন্দপুর থেকে কালীগঞ্জ থানা হয়ে আশাশুনি থানা পর্যন্ত ‘গড়’ খনন করেন।
ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত ঈশ্বরীপুরে কালের স্বাক্ষী হয়ে আজো এখানে অবশিষ্ট আছে অনেক কিছুই। সম্রাট আকবর যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয় ১২ ওমরাহকে। যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তাদের এখানে একই সঙ্গে দাফন করা হয়। ইট দিয়ে বাঁধানো এ কবরস্থানকে স্থানীয়রা বলেন, বারো ওমরাহর কবর। এ কবরের এক একটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ থেকে ১৪ হাত। এ স্মৃতিচিহ্নটিও এখনো চোখে পড়ে । এ কবরের পাশেই রয়েছে ৫ গম্বুজবিশিষ্ট ঐতিহাসিক শাহি মসজিদ। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে এ মসজিদের সংস্কার হয়েছে। মসজিদ থেকে আরো কিছুদূর গেলে চোখে পড়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পবিত্র যশোরেশ্বরী কালীমন্দির। অনেকে এ মন্দিরকে যশোরেশ্বরী দেবীর মন্দির বলে থাকে। এ মন্দিরের একটু দূরেই রয়েছে ভাঙাবাড়ির মতো দেখতে একটি ভবন। স্থানীয়ভাবে এটি ‘হাবসিখানা’ বলে পরিচিত। অনেকের মতে, এখানে আফ্রিকা থেকে আনা ক্রীতদাসদের রাখা হতো এবং একইসঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের শাস্তি দেয়া হতো।
এ ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন দেখতে, অতীত জানতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন এলাকায় লোকসমাগম হলেও রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানীর স্মৃতিচিহ্নের কাহিনীগুলি জানার কোনও ব্যবস্থা নেই।