মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক প্রবীন রাজনীতিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহমেদ।
মঙ্গলবার বাদ জোহর সাতক্ষীরা শহিদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে তার জানাজা নামাজে অগনিত জনতার ঢল নামে। এর আগে তার মরদেহে জেলার সর্বস্তরের মানুষ পুষ্পমাল্য অর্পনের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। জানাজা নামাজের আগে তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এসময় সৃষ্টি হয় বেদনা বিধূর পরিবেশ। জানাজা নামাজের আগে মরহুমের জীবন ও কর্ম তুলে ধরে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডাঃ আ ফ ম রুহুল হক-এমপি,সাতক্ষীরা ৪ আসনের সংসদ সদস্য এসএম জগলুল হায়দার, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, সাবেক এমপি আলহাজ্ব একে ফজলুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোশাররফ হোসেন মশু, জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু প্রমুখ। এ সময় মোবাইল ফোনে অডিও কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। জানাজা শেষে তাকে সাতক্ষীরার দেবহাটার পারুলিয়াস্থ গ্রামের বাড়িতে নেয়া হয়।
প্রসঙ্গত: সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাত ৭ টায় রাজধানী ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি প্রথমে করোনাক্রান্ত হয়ে সাতক্ষীরা সিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় যান।
মুনসুর আহমেদ ১৯৪৮ সালে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হামিজ উদ্দীন এবং মাতার নাম নাম দেলজান বিবি। সাতক্ষীরা পিএন হাইস্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন এবং খুলনা কমার্স কলেজ থেকে তিনি স্নাতক পাশ করেন।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আমল থেকে ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে হাতে খড়ি তার। এ সময় থেকে সকল রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার পক্ষে আন্দোলন করে রাজনীতির প্রথম সারিতে চলে আসেন তিনি। এরপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৯ এর গনআন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৭১ এ মুনসুর আহমেদ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। ৯ নং সেক্টরে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে একসাথে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৭২ সালে মুনসুর আহমেদকে দেবহাটার পারুলিয়ায় রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত করে সরকার। এরপর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন তিনি। পরপর ৩ বার একই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়া মনসুর আহমেদকে ১৯৭৫ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক করে তৎকালীন জিয়াউর রহমানের সরকার। তিনি টানা ২২ মাস কারাবন্দী থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৮০ সালে মুনসুর আহমেদ মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রানপুরুষ সৈয়দ কামাল বখ্ত সাকীর সাহচর্য্যে তার প্যানেল ভুক্ত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৪তে সাতক্ষীরা জেলা ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সর্বশেষ ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯ বছর যাবত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন মুনসুর আহমেদ। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মুনসুর আহমেদ ১৯৮৬ এর সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরার দেবহাটা-কালিগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও একইভাবে তিনি একই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ এর নির্বাচনে তিনি সামান্য ভোটে পরাজিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হকের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেন। ২০০৮ এর নির্বাচনে তিনি শ্যামনগর ও আংশিক কালিগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ২০১১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহমেদকে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। এর আগে ২০১৫ সালে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। একইভাবে ২০২১ সালে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় দফার সভাপতি নির্বাচিত হন। সদ্য গঠিত এই কমিটির প্রথম মিটিংও তিনি করে যেতে পারেননি। তিনি টানা ৪০ বছর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে দল ও আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন।
অত্যন্ত সদালাপী, বন্ধুবাৎসল এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যাংকার পুত্রসন্তান ও ডাক্তার কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। কিছুদিন আগে তার পত্নী বিয়োগ ঘটে।
তার মৃত্যুতে সাতক্ষীরা জেলার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মঙ্গলবার বাদ জোহর সাতক্ষীরা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে তার স্মরনে স্মরনকালের বৃহৎ জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশগ্রহন করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আফম রুহুল হক এমপি, এসএম জগলুল হায়দার এমপি, সাবেক এমপি একে ফজলুল হক, সাবেক এমপি বিএম নজরুল ইসলাম, সাবেক এমপি ডা. মোখলেসুর রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, ১৪ দলীয় নেতৃবৃন্দ, অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দ, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এবং সুশীল সমাজের সকল স্তরের মানুষ। কালিগঞ্জের নলতায় খানবাহাদুর আহছানিয়া মিশনে দ্বিতীয় দফা নামাজে জানাযা শেষে তাকে তার পারিবারিক গোরস্থান দেবহাটার পারুলিয়ায় দাফন করা হয়। এর আগে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
নামাজে জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা সাইফুল ইসলাম।