গত এক বছরে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা পাওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি কিছু এশিয়ান দেশেও বাংলাদেশি আবেদনকারীদের বিপুল সংখ্যক ভিসা আবেদন সরাসরি বাতিল বা দীর্ঘ সময় ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর দাবি, প্রতিনিয়ত ভিসা রিজেকশন ও বিলম্বিত প্রসেসিংয়ের কারণে পুরো ইন্ডাস্ট্রি চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন নামকরা ট্রাভেল এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে প্রায় ৭০ শতাংশ ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। বিশেষ করে শেনজেন ভিসা, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতার ও সিঙ্গাপুরে ভিসা রিজেকশনের হার কয়েক গুণ বেড়েছে।
ট্রাভেল এজেন্সি মালিক শাহীন হোসেন বলেন, “আগে যেখানে প্রতি ১০ জনে ৮ জন ভিসা পেতেন, এখন সেখানে ১০ জনে ২ জনও পাচ্ছেন না। এতে আমাদের ব্যবসা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে।”
কেন বাড়ছে রিজেকশন?
বিশ্লেষকদের মতে, ভিসা রিজেকশন বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে:
অতিরিক্ত ভুয়া ডকুমেন্টস জমা পড়া
কিছু এজেন্সির প্রতারণামূলক ভিসা প্রসেসিং
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও অভিবাসন উদ্বেগ
বিদেশে থেকে অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের সংখ্যা বৃদ্ধি
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কূটনৈতিক দুর্বলতা
ফলে, অনেক আবেদনকারী ইউরোপীয় বা আরব দূতাবাসগুলোতে পৌঁছেও ভিসা পাচ্ছেন না। এমনকি অনেক দূতাবাস এখন অ্যাপয়েন্টমেন্টও দিচ্ছে না।
বাংলাদেশি পাসপোর্ট কি ‘ব্ল্যাকলিস্টে’?
সরকারিভাবে এখনো এমন কোনো তথ্য প্রকাশ হয়নি যে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ‘ব্ল্যাকলিস্টে’ আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছু দেশ বাংলাদেশি আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে ‘রেড ফ্ল্যাগ’ চিহ্নিত করছে। ফলে আবেদনকারীরা নানা ধরনের জটিলতার মুখে পড়ছেন।
ভারতীয় ভিসা কার্যত বন্ধ – উদ্বেগ বাড়ছে ভারতের ভিসা বিভাগ গত কয়েক মাস ধরেই সাধারণ পর্যটন ভিসা কার্যত বন্ধ রেখেছে। বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা ভিসা সীমিত আকারে দিলেও ভ্রমণ বা আত্মীয় দেখা করার মতো সাধারণ আবেদনগুলো মাসের পর মাস ঝুলে থাকছে।
বিশেষ করে প্রথমবার আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই এতটাই কঠোর করা হচ্ছে যে অনেকেই হতাশ হয়ে আবেদন বাতিল করছেন।
একজন ভুক্তভোগী জানান, “ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাচ্ছি না। অনলাইন সিস্টেমে আবেদন জমা দিয়েও কোনো উত্তর আসে না। ট্রাভেল এজেন্সিগুলোরও কিছু করার নেই।”
ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ছায়া? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের এই ভিসা সীমাবদ্ধতা শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ নয়; দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাবও রয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একাধিকবার অনুরোধ করা হলেও এখনও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।
জনপ্রিয় ইউটিউব ভ্লগারের অভিজ্ঞতা
জনপ্রিয় ইউটিউব ভ্লগার Nadir On The Go, যিনি বাংলাদেশের অন্যতম সফল ট্রাভেল কন্টেন্ট ক্রিয়েটর, জানিয়েছেন—গত এক বছরে তিনি ১৭টি দেশের ভিসার জন্য আবেদন করেছেন, যার মধ্যে ৭টি দেশ তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
নাদির বলেন, “অনেকে ভাবে আমার পাসপোর্ট অনেক শক্তিশালী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমার এখনো বাংলাদেশি পাসপোর্ট, আর সেটার সীমাবদ্ধতা ভোগ করছি প্রতিনিয়ত।”
ভবিষ্যৎ কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট কাটাতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কার্যক্রমের উপর নজরদারি বৃদ্ধি এবং ভুয়া আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
ভিসা সহজ করতে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন:
দূতাবাসগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি
অনলাইন ভেরিফায়েড ডকুমেন্টস যাচাই
ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্সিং কঠোর করা
অবৈধ অভিবাসন রোধে সরকারি উদ্যোগ
বাংলাদেশি পাসপোর্ট বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল পাসপোর্টগুলোর মধ্যে অন্যতম।
২০২৫ সালের Henley Passport Index অনুযায়ী, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা মাত্র ৪১টি দেশে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করতে পারেন। তবে কার্যত এই সংখ্যা ২ শতাংশেরও কম বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।