কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, পাবনার ঈশ্বরর্দী, নাটোরের লালপুর ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি পদ্মার চরে জমি থেকে খড় কাটাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে তিনজন নিহত হয়েছে। গত ২৭ অক্টম্বর দুপুরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের ১৪ হাজার গ্রামের পদ্মার নতুন চরে এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর থেকে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন।
এ ঘটনায় সোমবার ২৭ অক্টোবর নিহত হন বাঘা উপজেলার খানপুর এলাকায় বসবাসকারী আমান মন্ডল ও নাজমুল মন্ডল। পরের দিন মঙ্গলবার ঘটনাস্থলের পাশ থেকে হাসুয়ার জখম ও গুলিবিদ্ধ ভেড়ামারার লিটনের
লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহতের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন সকালে মুন্তাজ মন্ডল ও রাকিব মন্ডল নিজ গোত্রের কিছু লোকজন নিয়ে খড় কাটতে জান চরে। খড়কাটার সময় অপর প্রান্ত থেকে শুরু হয় গুলিবর্ষণ। এতে নিহত হন আমান মন্ডল ও নাজমুল মন্ডল। গুরুত্বর আহত হয়ে রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন মোন্তাজ মন্ডল ও রাকিব। নিহতের পরিবারের দাবি গুলিবর্ষণকারীরা কথিত কাকন বাহিনির সদস্য। এ ঘটনায় নিহত আমান মন্ডলের পিতা মিনাজ মন্ডল বাদী হয়ে ২৩ জনকে আসামী করে দৌলতপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলার আসামী মুজা সর্দার নামের একজনকে আটক করেছে পুলিশ।
নিহতের ঘটনায় আমান মন্ডল ও নাজমুল মন্ডলের পক্ষে গত ৩১ অক্টোবর দুপুরে খানপুর বাজারে হত্যার বিচার দাবিতে মানববন্ধন করেন নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসী।
এ ঘটনায় কাকনের কোন সম্পৃক্ততা নেই বলে জানিয়েছেন তার লোকজন।
জানা গেছে, চরাঞ্চলে শুধু কাকন কিংবা মণ্ডল বাহিনী নয়, সক্রিয় রয়েছে টুকু, সাইদ, লালচাঁদ, রাখি, কাইগি, রাজ্জাক ও বাহান্ন বাহিনী। আর এই বাহীনির মধ্যে বিবাদের মূল কারণ, জমিদখল, বালু মহল দখল। আর এতে করে শঙ্কায় পড়ছে সাধারণ জনগন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পদ্মার ভাঙ্গনে বাড়িঘর বিলিন হওয়ায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ১৪ হাজার গ্রামের একই বংশের ৭২টি পরিবার একজোগে বসবাস শুরু করেন বাঘা উপজেলার খানপুর এলাকায়। গত ১৭ বছর যাবৎ তারা এ এলাকায় বসবাস করছেন অথচ এখনও তারা দৌলতপুর উপজেলার ভোটার। কেউবা আবার বাঘা এবং লালপুর উপজেলার ভোটার। তবে বেশিরভাগই এখনও দৌলতপুর উপজেলার ভোটার। এখানে বসবাসকারী মন্ডল বংশের অনেকেই নানা অপরাধে জড়িত বলে জানা যায়।
অনুসন্ধানে এ ঘটনার মূল রহস্য উন্মোচিত হয়, আওয়ামী লীগের আমলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। প্রশাসন বুঝতে পেরে ঐ স্থানটিকে বৈধ বালুমহল ঘোষণা করে নিয়মিত টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা প্রদান করেন। বর্তমানে ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় ‘মোল্লা ট্রেডার্স’ বৈধভাবে মহালটি পরিচালনা করছে। সেই বালু মহলের সঙ্গে ২০% শেয়ারে আছে এই কাকন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায় কাকন আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
এ বিষয়ে কাকন বাহিনির সদস্য শুকুর আলী বলেন, বিএনপির নেতা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পিন্টু চাঁদা দাবি করেন কাকনের কাছ থেকে। কাকন চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় বিরোধ। পরে পিন্টু হাত মেলায় বাঘায় বসবাসকারী দৌলতপুরের বেল্লাল মণ্ডলের সঙ্গে।
বেল্লাল মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরে মাদক, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত। তার বিরুদ্ধে বাঘা, চারঘাট, লালপুর ও ভেড়ামারা থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। অভিযোগ আছে, পদ্মা নদীর খাস জমি দখল করে বিক্রি করছে সে ও তার সহযোগীরা।
গত ২৭ অক্টোবর খড় কাটতে গিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনায় বেল্লালের হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দিন যতো গড়াচ্ছে এ ঘটনা ততটাই ধুয়াশা যুক্ত হচ্ছে। এ ধুয়ায়াশা ক্রমেই যেন ঘনিভূত হচ্চে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে চরাঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে একাধিক বাহিনী। তাহলে গুলিবর্ষণকারীরা কোন বাহিনীর তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে জনমনে। এছাড়াও ঘটনাস্থলে ৭- ৮ জন অস্ত্রধারীর উপস্থিতি থাকলেও মামলার আসামী কেন ২৩ জন কে করা হয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। অপর দিকে শঙ্কামুক্ত থাকতে প্রশাসনের তৎপরতা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন চরবাসী।
মুঠোফোনে বেল্লাল তার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কাকন বাহিনীর কাছে আমি একজন তুচ্ছ মানুষ। আর এ ঘটনায় নিহত হয়েছে আমার ভাগিনা ও ভাতিজা। আমি খুবই শোকাহত। তবে তিনি এ ঘটনায় তার কোন সম্পৃক্ততা নেই বলেও দাবি করেন।
এ বিষয়ে দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোলাইমান জানান, এ মামলার আসামী মুজা সরদার কে আটক করা হয়েছে। অন্যান্য আসামীদের আটকের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।